৩ নভেম্বর, ১৯৭৫ আরও এক নদী রক্ত

এস এম জাকির হোসাইন
বিশ্বে আজ একটি আলোকিত-আলোচিত দেশের নাম বাংলাদেশ। ৪৫ বছর আগে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সর্বাধুনিক রাষ্ট্র। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, উন্নয়ন সূচকের মাপকাঁঠিতে এ অঞ্চলের প্রায় সবগুলো দেশকে পেছনে ফেলেছি আমরা। তাই অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান, বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, আজকের বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে এক সাগর রক্তের উপর। অজস্ত্র রক্তের নদী মিলে, রক্তের সেই সাগর হয়েছে।

সেই রক্ত ৫২’র ভাষা শহীদের রক্ত, সেই রক্ত ১৯৭১ সালের ৩০ লাখ নিরস্ত্র মানুষ ও ২ লক্ষ নির্যাতিত মা-বোনের রক্ত, সেই রক্ত নিপীড়িত বাঙালির এক মহান নেতা ও তাঁর পরিবারের পবিত্র রক্ত, সেই রক্ত জাতির মহান ৪ নেতার বিশ্বস্ত রক্ত। বিন্দু বিন্দু জল যেমন সাগর-মহাসাগর গড়ে তোলতে পারে তেমনি বাঙালির জীবনে অনেক ঘটনার প্রবাহ মিলে রক্তের সাগর বানিয়েছে। এখনো সেই রক্তঝরা ক্ষতগুলো আমাদের ব্যথায় কাঁতর করে তোলে।

১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা অর্জন করি স্বাধীন, সার্বভৌম সোনার বাংলাদেশ। কিন্তু ১৯৭৫ সালে মাত্র ৭৯ দিনের ব্যবধানে বাঙালির জাতীয় জীবনে রচিত হয় দুই দুটি কলঙ্কিত রক্তাক্ত অধ্যায়। অল্প দিনের ব্যবধানে প্রবাহিত হয় আরও দুটি রক্তের নদী।

এ দুটি ঘটনায় বাংলাদেশ যাদের হারায় তাঁদের শূন্যস্থান পূরণ হবার নয়। প্রথমটি ছিল, ১৫ই আগস্ট, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা আর দ্বিতীয়টি, ৩রা নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় জাতির মহান ৪ নেতাকে নিষ্ঠুরতম ভাবে হত্যা করা।

নিস্বন্দেহে এই দুটি হত্যাকন্ডই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডগুলোর অন্যতম। শুধু এটুকু ভেবেই অবাক লাগে, যাদের মহান নেতৃত্ব ও মহান আত্মত্যাগের ফলে বাংলাদেশ নামক ভূ-খন্ডটি হয়েছিল স্বাধীন, তাঁদের কেই জীবন দিতে হল সেই স্বাধীন দেশে। অবশ্য বাংলাদেশকে স্বাধীন করাই ছিল তাঁদের অপরাধ। আর সে অপরাধের প্রাশ্চিত্য করতে হল শরীরের শেষ বিন্দু রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও তাঁর বিশ্বস্ত সহচর জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ড ছিল একই ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতা। খুনি-ষড়যন্ত্রকারীরা ভিন্ন ব্যক্তিও ছিল না। ৩ নভেম্বর জেলহত্যাকাণ্ডে আবার সেই খন্দকার মোশতাক, মেজর জিয়া, মেজর রশীদ, ক্যাপটেন মোসলেহ উদ্দিনসহ বঙ্গবন্ধুর খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীরাই সক্রিয় ছিল।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রকারীরা জাতীয় চার নেতাকে তাদের সরকারে যোগদানের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এই জাতীয় চার নেতা সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। এ কারণে তাদের নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়।

আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের এক মাত্র উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। কারণ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের কারণেই বাংলাদেশ, পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর তাদের স্বপ্ন ছিল পাকিস্তানি পেত্মাদের আবার এদেশে ফিরিয়ে আনা। আবার সেই পাকিস্তানি শাসন কায়েম করা।

১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর যেমন অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের বাহিরে রেখে পুরষ্কৃত করা হয়েছিল তেমনি ৩রা নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে কি হয়েছিল সে সব তথ্য ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও গোপন করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ২১ বছর পর তৎকালীন মহাকারাপরিদর্শক নুরুজ্জামানের জবানবন্দি উদ্ধার হওয়ায় জাতি অনেক সত্য জানতে পেরেছেন। আমি নিশ্চিত, সেই জবানবন্দিটি পড়ে কোনো মানুষ তার চোখের পানি ধরে রাখতে পারবে না…

৫ নভেম্বর, ১৯৭৫ সালে দেওয়া জবানবন্দিতে আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান বলেছেন, ‘এরপরই মেজর রশীদের আরেকটি ফোন পাই। তিনি আমাকে জানান, কিছুক্ষণের মধ্যেই জনৈক ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে যেতে পারেন। তিনি আমাকে কিছু বলবেন। তাকে যেন জেল অফিসে নেওয়া হয় এবং ১. জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, ২. জনাব মনসুর আলী, ৩. জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ৪. জনাব কামরুজ্জামান-এই ৪ জন বন্দিকে যেন তাকে দেখানো হয়। এ খবর শুনে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই এবং টেলিফোনে প্রেসিডেন্টকে খবর দেওয়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই প্রেসিডেন্ট জানতে চান, আমি পরিষ্কারভাবে মেজর রশীদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছি কি না। আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি আমাকে তা পালন করার আদেশ দেন… ক্যাপ্টেন মোসলেম বন্দুকের মুখে আমাকে, ডিআইজি প্রিজন, জেলার ও সে সময় উপস্থিত অন্যান্য কর্মকর্তাদের সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন। …তাদের নির্দেশ অনুযায়ী পূর্বলিখিত চারজনকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করা হয় এবং একটি রুমে আনা হয়, সেখানে জেলার তাঁদের সনাক্ত করেন। ক্যাপ্টেন মোসলেম এবং তার বাহিনী তখন বন্দিদের গুলি করে হত্যা করে। কিছুক্ষন পর নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল সবাই মারা গেছে কি না তা নিশ্চিত হতে জেলে আসে। তারা সরাসরি সেই ওয়ার্ডে চলে যায় এবং পুনরায় তাদের মৃতদেহ বেয়নেট চার্জ করে।’

মোসলেম উদ্দিন খুব কাছ থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে গুলি চালানোর সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ছাড়া বাকি ৩ জন সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। তাঁর হাটুতে ও পেটে গুলি লেগেছিল। তিনি পানি পানি বলে কাঁতরাচ্ছিলেন। তাঁকে পানি দেওয়ার মত পরিবেশও তখন ছিল না। এ্ই ছিল সেদিনের নিষ্ঠুরতার নমুনা।

১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের খুনিরা সভ্য পৃথিবীর সব ধরনের নিষ্ঠুরতাকে হার মানিয়েছে। আজকে প্রায় সময়ই বিএনপি নেত্রীকে টিভির সামনে বড় মুখ করে জঙ্গীদের জন্য মাঁয়া কাঁন্না কাঁদতে দেখা যায় কিন্তু তিনি একদিনও এই নিষ্ঠুরতম জেল হত্যা সম্পর্কে কিছেই বলে নি।সে সময় কোন আইনে এই মানুষগুলোর বিচার হয়েছিল, তার জবাব কি তার কাছে আছে?

১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের সঙ্গে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালের হত্যাকান্ডের অসম্ভব মিল আছে। পাকিস্তানিরা স্বাধীনতা বিজয়ের ঠিক একদিন জাতিকে মেধাশূন্য করতে নির্বিচারে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। খালেদ মোশাররফের পাল্টা সেনাঅভ্যুত্থানের ঠিক একদিন আগে মোশতাক, রশীদ, ফারুক আওয়ামী লীগের এই মহান নেতাদের হত্যা করে দেশ ছাড়েন। তাদের ভয় ছিল এই চার নেতা জন-সমর্থণ নিয়ে আবার সরকার গঠন করবেন।

তাই তাদের পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী লীগ যেন আর ওঠে দাঁড়াতে না পারে। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করাই ছিলো তাদের এক মাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ আজকে জাতির কল্যাণে যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ঐক্যবদ্ধ ও গণতন্ত্রমুখি। আজকে যত উন্নয়ন সব আওয়ামী লীগ সরকারের জন্যই সম্ভব হচ্ছে। জনগণকে যা দেওয়ার আওয়ামী লীগ সরকারই দেয়।

শুধু এইটুকু বলতে চাই হত্যাকান্ডের দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও বিচার পায়নি ৩ নভেম্বর নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার পরিবারগুলো। বর্তমান সরকারের উচিত যুদ্ধপরাধীদের বিচারের মত ৩ নভেম্বর হত্যাকরীদেরও বিচারের সম্মুখিন করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা।

বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে কিন্তু কোনো কলঙ্গের কালিমা যেন বাংলাদেশের গায়ে লেগে না থাকে। বিশ্বের বুকে আমরা হতে চাই কলঙ্কমুক্ত আত্মমর্যাদাশীল এক জাতি।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

LEAVE A REPLY