দেশে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১১ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এ রোগে আক্রান্ত মানুষের হার বাড়ছে। দেশে মৃত্যুর প্রথম পাঁচটি কারণের একটি ডায়াবেটিস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাপক বিস্তার ঘটা এই রোগ প্রতিরোধে দরকার জাতীয় নীতি প্রণয়ন।
এমন পরিস্থিতিতে আজ সোমবার দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস।
প্রতিরোধ ছাড়া কোনো পথ নেই—এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। এই ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে একত্র হয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। মানুষ সচেতন হলে আক্রান্তের হার কমবে। এটাই পথ। এ জন্য ডায়াবেটিস প্রতিরোধ জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
ডায়াবেটিক রোগীর হার বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায় যুক্তরাজ্যভিত্তিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট–এ প্রকাশিত এক গবেষণায়। গত ৯ এপ্রিল ল্যানসেট–এ প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ডওয়াইড ট্রেন্ডস ইন ডায়াবেটিস সিনস ১৯৮০: আ পুল্ড অ্যানালাইসিস অব ৭৫১ পপুলেশন বেসড স্টাডিজ উইথ ৪.৪ মিলিয়ন পার্টিসিপেন্টস’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের হার বেড়েছে। এই বৃদ্ধি নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে বেশি।
ল্যানসেট বলছে, ১৯৮০ সালে দেশের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। ২০০০ সালে আক্রান্ত পুরুষের হার বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ২০১৪ সালে এই হার বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৩ শতাংশে। নারীর ক্ষেত্রে চিত্রটি কিছুটা ভিন্ন। ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারী ও পুরুষের হার সমান, অর্থাৎ ৩ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল। ২০০০ সালে নারীর আক্রান্তের হার বেড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হয়। আর ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ পুরুষের চেয়ে ১ শতাংশ কম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের চিকিৎসক শাহজাদা সেলিম বলেন, ‘বিষয়টি এমন নয় যে মানুষ বাড়ছে বলেই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ বাড়ছে। ঘটনা হচ্ছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের হার দ্রুত বাড়ছে।’
অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ ডায়াবেটিস। গত বছর বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বা ৪৪ হাজার ৩৩৪ জনের মৃত্যু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে অবস্থিত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড
ইভালুয়েশন, বিশ্বব্যাংক ও ল্যানসেট–এর যৌথ বিশ্লেষণে মৃত্যুর পাঁচটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়। অন্য প্রধান কারণগুলো হচ্ছে, মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ (সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ), হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগ (স্কিমিক হার্ট ডিজিজ), দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ (সিওপিডি) ও শ্বাসতন্ত্রের নিচের অংশের সংক্রমণ (লোয়ার রেসপিরেটরি ইনফেকশন)।
বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের জাতীয় পর্যায়ের তথ্য পাওয়া যায় ২০১১ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে। এতে বলা হয়েছিল, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১১ শতাংশ নারী–পুরুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আক্রান্ত ব্যক্তিদের হার শহরে বেশি। এ ছাড়া ২৫ শতাংশ নারী ও পুরুষ প্রাক্–ডায়াবেটিস পর্যায়ে আছে। অর্থাৎ তাঁদের রক্তে শর্করা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস হচ্ছে জীবনধারাজনিত (লাইফস্টাইল) রোগ। কায়িক শ্রম কমে যাওয়া, কম হাঁটা, অধিক তেলযুক্ত খাবার ও ফাস্টফুড খাওয়া, খেলাধুলা না করা, স্থূল হওয়া, মানসিক চাপ—এসব কারণে ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে।
রক্ষণশীল হিসাবে বাংলাদেশে ৮০ লাখের বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন বলছে, মানসম্পন্ন সেবার জন্য একজন রোগীর পেছনে বছরে কমপক্ষে ২৮ মার্কিন ডলার খরচ করা দরকার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশের এই বিরাটসংখ্যক মানুষকে মানসম্পন্ন সেবা দিতে হলে স্বাস্থ্য বাজেটের বড় অংশ শুধু ডায়াবেটিস খাতে রাখতে হবে।
আজ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস: আজ বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। অন্যান্য বছরের মতো এবারও বিভিন্ন সংগঠন দিবসটি পালন উপলক্ষে নানা কর্মসূচি নিয়েছে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘ডায়াবেটিসের ওপর নজর রাখুন’। এর অর্থ হলো, লক্ষণ নেই এমন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রক্ত পরীক্ষা করে ডায়াবেটিসের পরিস্থিতি জানা, পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আগেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসার আওতায় আনা এবং ডায়াবেটিস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।
দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি আজ দুপুরে বারডেম মিলনায়তনে সেমিনারের আয়োজন করেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সংশ্লিষ্ট বিভাগ শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। বেসরকারি অ্যাপোলো হাসপাতালও একই ধরনের কর্মসূচি নিয়েছে।