সোসাইটিনিউজ ডেস্ক: ইঁদুর নামক প্রানীটির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। অনেকেই এই প্রানীটির ক্ষতিকর দিকটিকে গ্রাহ্য না করায় এর দমন ব্যবস্থার প্রতি সচেতনতা দেখান না। তবে যারা একবার প্রানীটি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তারা এর দমন বা নিধনের ব্যাপারে সজাগ। প্রানীটি ক্ষুদ্র হলেও এর ক্ষতিকর দিকটি বিশাল।
আমাদের দেশে প্রতি বছরই এই প্রানীটির নিধনের জন্য সরকরী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিশেষ অভিযান চালানো হয় যাকে আমরা ইঁদুর নিধন অভিযান নামে আখ্যায়িত করে থাকি। অনেকেই এই অভিযানের সময় বিরুপ মন্তব্য করে থাকেন। কিন্তু যখন তারা এই অতি তুচ্ছ প্রানীটি দ্বারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন তখন প্রানীটির নিধনের গুরুত্বটি হাড়ে হাড়ে টের পান।
ইঁদুরের বিচরন ক্ষেত্র ফসলের ক্ষেত থেকে শুরু করে বাড়ির শোবার ঘর পর্যন্ত সর্বত্র। আর তাই এদের ক্ষতির ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। এরা মাঠের ফসল, গুদামজাতশস্য, ফল, শাকসবজি, সংরক্ষিত বীজ, কাপড়-চোপড়, কাগজ, লেপ-তোষক ইত্যাদি কাটাকুটি করে আমাদের প্রচুর ক্ষতি সাধন করে। এরা যে শুধুই কাটাকুটি করে আমাদের ক্ষতি করে তাই নয়, এরা মানুষ ও পশুপখির মধ্যে প্লেগ, জন্ডিস, টাইফায়েড, চর্মরোগ, আমাশয়, জ্বর, কৃমিসহ প্রায় ৪০ প্রকাররোগ জীবানুর বাহক ও বিস্তারকারী।
একটি ইঁদুর প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৭ গ্রাম খাদ্য খেয়ে থাকে। ইঁদুরের উভয় দন্তপাটিতে সামনে এক জোড়া করে খুব তীক্ষè দাঁত আছে যা জন্মের পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বাড়তেই থাকে। আর এই সদা বর্ধিষ্ণু দাঁতকে স্বাভাবিক অবস্থায় রাখার জন্য ইঁদুর সর্বদা কাটাকুটি করতে থাকে। ফলে ইঁদুর যা খায় তার চেয়ে চার/পাঁচগুন খাবার নষ্ট করে থাকে। তাই ইঁদুরের ক্ষতি এত ভয়াবহ। সারা পৃথিবীতে প্রায় ৪১০০ টির মত স্তন্যপায়ী প্রানীর প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে যার মধ্যে ১৭০০ টি মত ইঁদুরের প্রজাতি পাওয়া গেছে। তবে এদের সবগুলোই মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়।
২০ টির মত প্রজাতিকে ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইঁদুর প্রানীটি অতি ক্ষুদ্র হলে কি হবে, এদের ঘ্রান,আস্বাদন ও শ্রবন শক্তি অতি প্রবল। ইঁদুর বর্তমানে পোলট্রি ফার্মে ছোট বাচ্চা ও ডিম খেয়ে ফার্মের মালিকদের মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঠের ফসল ছাড়াও সেচের নালায় গর্ত করার মাধ্যমে সেচের পানির ব্যাপক অপচয় ঘটায়। শুধু তাই নয় সড়ক, মহাসড়ক, বাঁধ এসব স্থানেও গর্ত খোড়ার ফলে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে থাকে।
ইঁদুর সাধারনত ভিটা মাটির গর্তে, বসতবাড়ির আশে-পাশে,ফসল ক্ষেতের মাটির গর্তে,বাঁধ বা রাস্তার গায়ে তৈরি গর্তে, ফসলের গোলা বা গুদাম ঘরে বসবাস করে। এছাড়াও হাওড়, বিল, ঝিল ও নিচু এলাকায় বসবাস করতে দেখা যায়। বন্যা কবলিত অঞ্চলে মাঠের কালো ইঁদুর ও মাঠের বড় কালো ইঁদুর উচুঁ গাছে,কচুরিপানায়, অপেক্ষাকৃত উচুঁ স্থানে, বনে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে থাকে।
প্রজাতি ভেদে ইঁদুর ১৫-৪১ সেঃমিঃ লম্বা এবং ওজনে ১৫-৩২৬ গ্রাম হয়ে থাকে। আমাদের দেশে যে সকল প্রজাতির ইঁদুর দেখা যায় সেগুলো মধ্যে নরওয়ে বা বাদামী ইঁদুর, বাতি বা সোলাই ইঁদুর, মাঠের কালো ইঁদুর, মাঠের বড় কালো ইঁদুর, মাঠের নেংটি ইঁদুর, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর এবং প্যাসিফিক ইঁদুর উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে নরওয়ে বা বাদামী ইঁদুর ঘরের ও গুদামজাত শস্যের ক্ষতি করে থাকে, ঘরের ইঁদুর বা গেছো ইঁদুর গুদামজাত শস্য, ফলজাতীয় ফসল এবং আসবাবপত্রের ক্ষতি করে, বাতি বা সোলাই ইঁদুর ঘরের বই-পত্র, কাপড়-চোপড় এবং শস্যদানা নষ্ট করে থাকে, মাঠের কালো ইঁদুর সব ধরনের মাঠ ফসল ও গুদামজাত ফসলের ক্ষতি করে থাকে, মাঠের বড় কালো ইঁদুর জলী আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি করে, মাঠের নেংটি ইঁদুর মাঠের দানা জাতীয় ফসল পাকার পর ফসলের ক্ষতি করে থাকে, নরম পশমযুক্ত ইঁদুর ধান গম বার্লির ক্ষতি করে থাকে এবং প্যাসিফিক ইঁদুর-ফলজ গাছ বিশেষ করে নারকেল গাছের ক্ষতি করে থাকে।
ইঁদুর খুব দ্র”ত বংশ বৃদ্ধি করে থাকে। ইঁদুরের গর্ভধারনকাল প্রজাতিভেদে ১৮-২৬ দিন। স্ত্রী ইঁদুর বাচ্চা প্রসবের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পুনরায় গর্ভধারন করতে পারে। তবে বাচ্চাদের বাসস্থান, খাদ্য ও পানি নিশ্চয়তা না পেলে গর্ভধারন করে না। এরা প্রজাতি ভেদে বছরে ৬-৮ বার বাচ্চা প্রসব করে থাকে। প্রতিবার প্রজাতি ভেদে ৩-১৬ টি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করে থাকে। জন্মাবার ২-৩ মাসের এরা আবারও বাচ্চা দেবার উপযুক্ত হয়। এক জোড়া ইঁদুর থেকে ২০০০-৩০০০ বংশধরের সৃষ্টি হয়।
ইঁদুর দমন বা নিধনের জন্য এদের উপস্থিতি সনাক্ত খুব জরুরী। আমরা যে জিনিসগুলো পর্যবেক্ষন করলে সহজেই এদের উপস্থিতি বুঝতে পারব তা হল- মাঠে ইঁদুরের গর্ত দেখে, ধান বা গমের কুশি গোছ গোছ আকারে কাটা দেখে, ধান ও গমের ক্ষেতের গর্তে যথাক্রমে ধান ও গম দেখে, ফলবাগানে আক্রান্ত আনারস, নারকেল দেখে, আখ ক্ষেতের আক্রান্ত আখ দেখে, ঘর ও গুদাম ঘরে রাখা ধান চাল গম-এর বস্তা কাটা দেখে, ইঁদুরে খাওযা ধানের তুষ দেখে, নরম মাটি বা বালিতে ইঁদুরের পায়ের ছাপ দেখে, মাঠ বা বসতবাড়ির আশে-পাশে ইঁদুরের মল দেখে এবং ঘর বা গুদাম ঘরে রক্ষিত শস্যের পাশে ইঁদুরের মল দেখে।
ইঁদুরের উপস্থিতি সনাক্তকরনের সাথে সাথে এর নিধন বা দমনের কথা স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। আমারা যে সকল ব্যবস্থাপনা দ্বারা ইঁদুরকে দমন বা নিধন করতে পারি তা হল ঘর-বাড়ি আশে-পাশে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রেখে, ক্ষেতের আশে-পাশে ঝোপ-ঝাড়, আগাছা, বন-জঙ্গল পরিস্কার করে, গুদাম ঘর পরিস্কার, রেখে এবং গুদামের দরজার ফাঁক এবং ঘরের ফাটল বন্ধ করে, গুদামে শস্য টিনের পাত্রে সংরক্ষন করে, ধান গম ইত্যাদির গোলা বা ডোল সরাসরি মাটিতে না রেখে মাচার উপরে তৈরি করা ঘরে রেখে এবং মাচার প্রতিটি খুঁটিতে টিন জড়িয়ে দিয়ে যাতে ইঁদুর তা বেয়ে না উঠতে পারে, খাড়া নারকেল গাছের ক্ষেত্রে গোড়ায় টিনের মসৃনপাত জড়িয়ে দিয়ে যাতে ইঁদুর তা বেয়ে না উঠতে পারে, ইঁদুর ভক্ষনকারী প্রানীকে সংরক্ষণ করে, ইঁদুর ধরে এবং পিটিয়ে মেরে, ইঁদুরের গর্ত খুড়ে, গর্তে পানি ঢেলে, গর্তে মরিচ পোড়ার ধোঁয়া দিয়ে এবং ইঁদুর নিয়ন্ত্রনের পরিপূরক ব্যবস্থা
হিসেবে ফাঁদ বা খাঁচা ব্যবহার করা যেতে পারে। ইঁদুর ধরা কল সাবান পানিতে ভালবাবে ধুয়ে পুনরায় ব্যবহার করতে হবে অন্যথায় কোন কারনে কলে দুর্গন্ধ থাকলে ইঁদুর ধরা পড়বে না।
রাসায়নিক বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে ইঁদুর দমন বা নিধন করা সম্ভব। যে সকল রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর নিধন করা সম্ভব সেগুলো হল।
- তীব্র বিষ :- তীব্র বিষ হচ্ছে জিংক ফসফাইড। এটি খাবার সাথে সাথে ইঁদুর মারা যায়। জিঙ্ক ফসফাইডের বিষ টোপ প্রস্তুত করার জন্য প্রতি ৪০ ভাগ আটা ময়দার সঙ্গে ১ ভাগ বিষ ও ৩ ভাগ গুড় এবং পরিমান মত তেল মিশিয়ে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করে জায়গায় জায়গায় রেখে দিতে হবে। বিষ টোপ ব্যবহার করার আগে কিছু দূর অন্তর অন্তর ৩ থেকে ৪ দিন বিষ ছাড়া টোপ সন্ধার আগে রেখে দিতে হবে। এই ফাঁকা বিষ টোপ কয়েকদিন খাওয়ার পরে সেই সব জায়গায় বিষ টোপ প্রয়োগ করতে হবে। তীব্র বিষ টোপ ব্যবহারে কিছু কিছু অসুবিধা আছে তা হল জিঙ্ক ফসফাইড দ্বারা তৈরি করা বিষ টোপ ইঁদুর পরিমিত মাত্রায় খাওয়ার আগে অল্প কিছুটা মুখে দিয়ে পরখ করে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে কিন্তু মরে না। আবার পরিমিত মাত্রায় বিষটোপ খাওয়ার পর এক সাথে অনেকগুলো ইঁদুর মারা যেতে দেখে যেসব ইঁদুর বিষটোপ খাইনি তাদের বিষটোপের প্রতি অনিহা লক্ষ্য করা যায়।একে ইঁদুরের বিষটোপ লাজুকতা বলে।কাজেই বিষটোপ ব্যবহার করে মাঠের বা ঘরের সব ইঁদুর দমন করা সম্ভব নয়।
- দীর্ঘস্থায়ী বিষ :- এ ধরনের বিষ খাওয়ার সাথে সাথে ইঁদুর মারা যায় না। ইঁদুর মারা যেতে ৫ থেকে ৭ দিন সময় লাগে। দীর্ঘস্থায়ী বিষ হচ্ছে রেকুমিন, ব্রোডইফেকুন থেকে দীর্ঘস্থায়ী বিষ দিয়ে তৈরিকৃত বিষটোপ ইঁদুর খাওয়ার পর ইঁদুরের রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পায়,ফলে ইঁদুরের নাক, মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে এবং ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে মারা যায়। এ ধরনের বিষ প্রয়োগে অনেক ইঁদুর মারা সম্ভব।
- বিষবাষ্প প্রয়োগ :- গ্যাস বড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে বিষটোপ প্রয়োগ করে গর্তের ইঁদুর মারা খুবই কার্যকর। একটি গর্তে একটি গ্যাস বড়ি প্রয়োগ করে গর্তের সকল মুখ ভালভাবে বন্ধ করে দিতে হবে। পরের দিন যদি গর্তের মুখ খোলা পাওয়া যায় তবে আরো একটি গ্যাস বড়ি অনুরূপভাবে প্রয়োগ করতে হবে। মাঠ ফসলের ক্ষেত্রে থোড় থেকে পাকা অবস্থা পর্যন্ত গ্যাস বড়িগুলো হল অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড।
এছাড়াও প্রাকৃতিকভাবে ইঁদুরের জৈবিক দমন করার জন্য আমরা কিছু পরভোজী প্রানীকে ব্যবহার করতে পারি । এ ধরনের প্রানীর মধ্যে বিড়াল অন্যতম। এছাড়া ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস রোগজীবানু ব্যবহার করে ইঁদুরের রোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ইঁদুর দমন এবং রাসায়নিক বন্ধ্যাত্বকরন পদার্থসমূহের মাধ্যমে ইঁদুরের বংশ বৃদ্ধিতে বাধার সৃষ্টি করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইঁদুর দমনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও এ সব জৈবিক পদ্ধতি ইঁদুর দমনের জন্য ব্যবহার করা যায়নি। কারন ইঁদুরের রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসসমূহ এবং ইঁদুরের বন্ধ্যাত্বকরনে ব্যবহারযোগ্য রাসায়নিক পদার্থসমূহ মানুষের জন্য একই প্রকারের ক্ষতিকারক।
মাঠের বা ফসলের ইঁদুর একক প্রচেষ্টায় দমন বা নিধন করা একেবারেই সম্ভব নয়। ইঁদুর নিধনের জন্য সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম প্রস্তুত করে বিরাট এলাকায় এলাকাবাসী বা গ্রামবাসীদের যৌথ উদ্যোগ গ্রহন করলে এর দমন ফলপ্রসু হবে। তবে ইঁদুর দমনের জন্য সর্বপ্রথমে এর ক্ষতির দিক সম্বন্ধে আমাদের সচেতন হতে হবে। কারন আমাদের সমগ্র ফসলের প্রায় শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ ইঁদুর দ্বারা ক্ষতি গ্রস্থ হয়। যখন আমাদের মাঝে ইঁদুর-এর ক্ষতির ভয়াবহতার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হবে তখনই এই ক্ষুদ্র প্রানীটির বিশাল ক্ষতির হাত থেকে আমরা রেহাই পেতে সক্ষম হব।