লাল ফিতার দৌরত্বে আটকে আছে গ্যাস সংযোগ

প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ এবং দেশের স্বার্থে আমি অধিক গুরুত্ব বিবেচনায় গ্যাস তোলা ও গ্যাস সংযোগ দেয়ার পক্ষে। তবে কতটুকু কাজ করতে পারব জানি না। কারণ এসব কাজে তদবির আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা খুব বেশি। একটা কাজের জন্য একশ’বার তদবির করতে হয়। এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে আমরা কয়েদির মতো আটকা পড়ে গেছি।

শনিবার আমাদের প্রতিনিধিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ছোট ভাই এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ড. এ কে আবদুল মোমেন।

তিনি বলেন, গ্যাস সংযোগের ব্যাপারে জ্বালানি উপদেষ্টা প্রমিজ করে বলেছিলেন, ঈদের পরই শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেয়া শুরু হবে। কিন্তু সেই কবে ঈদ গেল, আজও কোনো প্রতিষ্ঠানেই গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়নি। ড. মোমেন মনে করেন, এসব সমস্যা প্রধানমন্ত্রীর দেখানো উন্নয়ন সম্ভাবনার জন্য প্রতিকূল। তবে শিল্পে গ্যাস সংযোগ দ্রুত কার্যকর করতে না পারলে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

তিনি বলেন, দেশের সার্বিক স্বার্থে এখন শিল্প প্রতিষ্ঠায় বেশি করে জোর দিতে হবে। কেননা শিল্পায়ন হলে কর্মসংস্থান হবে, উৎপাদন বাড়বে। আর সিলেট শিল্পায়নের জন্য সম্ভাবনাময় এলাকা। এখানে বড় শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার সহায়ক পরিবেশ রয়েছে। অনেক জায়গা আছে, কাঁচামাল রয়েছে; যার ওপর নির্ভর করে অনেক শিল্প গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাধা একটাই- গ্যাস সংযোগ না পাওয়া।

ড. মোমেন বলেন, গ্যাস সংযোগের সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে জ্বালানি উপদেষ্টার কথা হয়েছে। আমি বললাম, শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস দেন। গ্যাস না দিলে কীভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। তিনি প্রমিজ করে বলেছিলেন, ঈদের পরই শিল্প কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেয়া শুরু হবে। কিন্তু সেই কবে ঈদ গেল কোনো প্রতিষ্ঠানেই গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়নি। পরে শুনলাম তিনি বিদেশে চলে গেছেন। গ্যাস সংযোগ প্রদান কমিটির চেয়ারম্যান আবার জ্বালানি উপদেষ্টা নিজেই।

তিনি বলেন, জ্বালানি উপদেষ্টার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয় মূলত ই-মেইলে। কিন্তু সম্প্রতি তিনি ই-মেইলও বদলে ফেলেছেন। মেইল করার পর দেখি মেইল ফেরত এসেছে। উনার নতুন ই-মেইল পেলে আবারও মেইল পাঠাব। ড. মোমেন বলেন, তিনি বিদেশে, আর গ্যাসের জন্য মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে ড. মোমেন জানান, মৌলভীবাজারে মাটির নিচে ৩০ থেকে ৫০ মিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাস আছে। কিন্তু এই গ্যাস নাকি ন্যাশনাল গ্রিডে যাবে না, প্রেসার কম। যদি ন্যাশনাল গ্রিডে না যায় তবে তা দিয়ে স্থানীয় চাহিদা মেটানো সম্ভব। এতে গ্যাস সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে। তিনি বলেন, গ্যাস তোলা গেলে পুরো সিলেট বিভাগে শিল্প বিপ্লব ঘটবে। কী কী হবে তা বলে শেষ করা যাবে না।

এ নিয়ে একপর্যায়ে সংশয় প্রকাশ করে ড. মোমেন বলেন, অনেক আগ্রহ আছে। কিন্তু বাস্তবে কতটুকু কাজ করতে পারব জানি না। কারণ তদবির আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এত বেশি যে, একটা কাজের জন্য একশ’বার তদবির করতে হয়। এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে আমরা সবাই কয়েদির মতো আটকা পড়ে গেছি। সংকট নিরসন করতে হলে এসব জটিলতা সারিয়ে ওয়ানস্টপ সার্ভিস দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, এ দেশের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, স্বপ্ন কী আমরা এরই মধ্যে জানতে পেরেছি। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন। এর মধ্যে কিছু দৃশ্যমান, বাকিগুলো অদৃশ্য। দেখা না গেলেও অনুভব করার মতো। তবে উদ্যোগ কার্যকর না হলে স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

তিনি বলেন, বিনিয়োগ এমন এক বিষয় সেখানে একজনকে দেখে আরেকজন এগিয়ে আসেন। কিন্তু এখন কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ যেভাবে আটকে আছে তাতে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন।

বিনিয়োগে অনুৎসাহিত হওয়ার উদাহরণ হিসেবে আক্ষেপ করে ড. মোমেন বলেন, আমি সিলেটের এক ভদ্রলোককে বিদেশ থেকে ধরে আনলাম। তিনি ১৪২তলা বিশিষ্ট বিশ্বের দ্বিতীয় সুউচ্চ ভবন ঢাকায় করতে রাজি হলেন। এজন্য চাইলেন শুধু জমি। তাও আবার নগদ টাকায়। কিন্তু শেষমেশ তাকে চাহিদামতো জমি দেয়া হল না। ফিরে গেলেন তিনি। এখন কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী তাকে টাকা-ভূমি দুটোই দিচ্ছেন। কলকাতায় তিনি ৭শ’ বেডের হাসপাতালও করেছেন। অথচ বাংলাদেশেই হাসপাতালও করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রায় ২ মিলিয়ন ডলার খরচ করার পর ফিরে গেছেন। এই হল আমাদের অবস্থা। মালয়েশিয়া মাত্র ৬৬তলা ভবন করেছে সেখানে সারা বিশ্বের লোকজন আসে। আমাদের এখানে ১৪২তলা হলে বিশ্বের কত মানুষ আসত।

ড. মোমেন যুগান্তরকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য গুণগত শিক্ষা ও দক্ষ জনবলের জরুরি প্রয়োজন। দক্ষ জনবল না থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনা ঘটবে। নিরাপত্তার ব্যাপারে তারা অজ্ঞ ছিল বলেই এমন ঘটনা ঘটেছে। হোঁচট খেতে হয়েছে। তাই সব স্তরে কোয়ালিটি, স্কিলড জনবল প্রয়োজন।

তিনি বলেন, ঢাকায় না গেলে আমাদের কোনো কাজ হয় না। অথচ আমেরিকার কাউকেই ওয়াশিংটন যেতে হয় না। আমাদের এই ব্যবস্থারও পরিবর্তন দরকার। তা না হলে উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, আমাদের মানুষ খুব পরিশ্রমী। তারা শুধু সুযোগ চায়। তাদের কাজের সুযোগ করে দিলে দেশ এগিয়ে যেতে বাধ্য। আমি বিদেশে ছিলাম, দেখেছি বাংলাদেশী শ্রমিকের শ্রম ও তাদের প্রশংসা।

সবশেষে ড. মোমেন তার স্বপ্নের কথা বলেন এভাবে- আমি চাই সেই বাংলাদেশ, যে দেশের পাসপোর্ট নিয়ে গেলে আমাদের যেন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কেউ তাকানোর সাহস না পায়। আমার বিশ্বাস, আমরা এগিয়ে গেলে কাক্সিক্ষত অর্জন হবেই।

প্রসঙ্গত, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামীতে নির্বাচন না করার ঘোষণা দিয়েছেন অনেক আগেই। এরপর থেকে সিলেট-১ সদর আসনে তৎপর রয়েছেন অর্থমন্ত্রীর ছোট ভাই ড. এ কে আবদুল মোমেন। আগামী নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে তিনিই আওয়ামী লীগের প্রার্থী হচ্ছেন তা অনেকটা নিশ্চিত।

ড. মোমেন জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি ছাড়াও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আস্থাভাজন ড. মোমেন দল বা সরকারের উল্লেখযোগ্য কোনো পদে না থাকলেও অঘোষিতভাবে অনেক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

LEAVE A REPLY