সারাদেশে বধ্যভূমির এ কী হাল!

দেশের বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এ উদ্যোগে সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ১৯৩টি বধ্যভূমি থেকে ৩৫টি বাছাই করে সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। প্রকল্প বানিয়ে প্রায় ৬০ কোটি টাকা খরচ করে ২০০৪ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ওই বধ্যভূমিগুলোতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছিল।

নির্মাণের প্রায় আট বছর পর এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ওই স্মৃতিস্তম্ভগুলোর মধ্যে ১২টির প্রকৃত অবস্থা জানতে সরেজমিনে পরিদর্শন করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিনিধিদল। আইএমইডির তৈরি করা প্রতিবেদনে বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভগুলোর বেহাল দশা উঠে এসেছে।

এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, অনেকটা জরাজীর্ণ, পরিত্যক্ত ও অরক্ষিত অবস্থায় বেশির ভাগ স্মৃতিস্তম্ভ পড়ে আছে। সন্ধ্যা নামলেই বেশির ভাগ বধ্যভূমিতে নেশাখোরদের আড্ডা বসে। অনেক বধ্যভূমিতে যাওয়ার কোনো সড়কও নেই। কোনোটি এখন রিকশা ও টেম্পো গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব বধ্যভূমি দেখার কেউ নেই। এমনকি দু-একটি ছাড়া এসব বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসসহ অন্যান্য জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান হয় না।

বধ্যভূমি নিয়ে তৈরি করা আইএমইডির প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন সংস্থাটির মহাপরিচালক আল মামুন। তিনি জানান, এ প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামো উন্নয়ন করা বধ্যভূমিগুলোর বর্তমান অবস্থা বেশ খারাপ। এ বিষয়ে আইএমইডি কিছু সুপারিশ করে তিন-চার মাস আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো জবাব মেলেনি।

গত জুন মাসে আইএমইডির প্রতিনিধিদল যেসব বধ্যভূমি পরিদর্শন করে, সেগুলো হলো যশোরের কালীতলা, গাইবান্ধার পলাশবাড়ী, বরিশাল সদর, ফরিদপুরের নগরকান্দা, বগুড়া সদর, কুমিল্লা সদর, কিশোরগঞ্জ সদর, শেরপুরের ঝিনাইগাতী, নীলফামারীর সৈয়দপুর, নাটোরের ফুলবাগান, হবিগঞ্জের বাহুবল ও রাজধানীর মিরপুরের জল্লাদখানা বধ্যভূমি।

boddho-vumi-2

প্রথম আলোর পক্ষ থেকেও চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কিশোরগঞ্জ, বগুড়া ও গাইবান্ধার তিনটি বধ্যভূমি সরেজমিনে দেখা হয়। আইএমইডির প্রতিবেদনের সঙ্গে মিল তো পাওয়া গেছেই, বরং কিছু ক্ষেত্রে বাস্তব চিত্র আরও খারাপ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বগুড়া শহরের বধ্যভূমির মূল স্মৃতিস্তম্ভের পাশে চট দিয়ে শৌচাগারতৈরি করা হয়েছে। সামনের রাস্তা দখল হয়ে গেছে রিকশা ও টেম্পোর গ্যারেজে। আর কিশোরগঞ্জের দানাপাঠুলীর বধ্যভূমির মূল স্মৃতিস্তম্ভটির নিচের মাটি সরে গেছে। ফলে স্মৃতিস্তম্ভটি যেকোনো সময়ে ভেঙে পার্শ্ববর্তী সিংগুয়া নদীতে পড়তে পারে।

অন্যদিকে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর ঝোপঝাড়ে ভরা বধ্যভূমিটির সীমানাপ্রাচীর ভেঙে গেছে। এটি এখন গবাদিপশুর অবাধ চারণক্ষেত্র।

যোগাযোগ করা হলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এ হান্নান বলেন, বধ্যভূমিগুলোর বেহাল দশা আর থাকবে না। এসব বধ্যভূমি সংস্কার করার জন্য আলাদা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, ২০০৪ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে যেসব বধ্যভূমির উন্নয়ন করা হয়েছিল, এত দিন সেগুলোর কর্তৃত্ব স্থানীয় কোনো কর্তৃপক্ষের হাতে ছিল না। তাই হয়তো সেখানে অযাচিত লোকজন ঢুকে পড়তে পারে। তবে সংস্কারের পর বধ্যভূমিগুলো স্থানীয় কোনো কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হবে।

আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই ১২টি বধ্যভূমির মধ্যে একমাত্র মিরপুর জল্লাদখানা বধ্যভূমি ছাড়া আর কোনোটিতে বিদ্যুৎ-সংযোগ নেই, দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামাগার ও টয়লেট নেই, নিরাপত্তাকর্মী নেই। অরক্ষিত বধ্যভূমিগুলোতে কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই, নামফলকও নেই। সব কটি বধ্যভূমি ভীষণ নোংরা ও আবর্জনায় পরিপূর্ণ।

এ ছাড়া নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভগুলোর অবকাঠামো নষ্ট হয়ে গেছে। আবার নকশা অনুযায়ী কাজও হয়নি। আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিদর্শন করা ১২টি স্মৃতিস্তম্ভের মধ্যে ১০টির মূল স্তম্ভ নষ্ট হয়ে গেছে। যশোর, বগুড়া ও কিশোরগঞ্জে কোনো সীমানাপ্রাচীর ও পতাকা বেদি নেই। এ তিনটির পাশাপাশি বরিশালেও সীমানাপ্রাচীর নেই।

আইএমইডি আরও বলেছে, স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, নামমাত্র খরচ করে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছেন ঠিকাদারেরা। ঠিকাদার নির্বাচন করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প হলেও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছে গণপূর্ত বিভাগ। তবে এসব স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শেষে কোনো দপ্তরের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। তাই অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ আত্মদানকারী শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভগুলো।

এ বিষয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, বধ্যভূমিতে শুধু স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলেই হবে না, এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনকে দিতে হবে। আবার এসব স্মৃতিস্তম্ভের দেখভালের দায়িত্ব ওই এলাকার সাধারণ মানুষেরও। তবে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার। তাঁর মতে, অতীত-বর্তমান সব সরকারের মধ্যেই একাত্তরের স্মৃতিগুলোর প্রতি অবহেলার প্রবণতা রয়েছে।

গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্যোগও তেমন নেই। তিনি আরও বলেন, ‘গণহত্যার শিকার অনেক দেশই প্রতিবছর একটি দিনে গণহত্যা দিবস পালন করে। কিন্তু আমরা ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের সুপারিশ করলেও সরকার এখনো তা বাস্তবায়ন করেনি।’

LEAVE A REPLY