শ্রমিক বিক্ষোভের মুখে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের ৫৯ টি তৈরি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করার পর আশুলিয়া বৃহস্পতিবারও ছিল শান্ত। সকালে বন্ধ কারখানাগুলোর সামনে শ্রমিকরা জড়ো হলে আগে থেকে অবস্থানে থাকা পুলিশ তাদের কারখানার সামনে থেকে সরিয়ে দেয়।
এদিকে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ডিইপিজেড) ও সাভার এলাকায় পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিকরা সুষ্ঠু ভাবে কাজ করছেন। মহাসড়কে চলাচলরত কয়েকজন শ্রমিকের সাথে আলাপ হয়। তারা বলেন, শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবির সঙ্গে তারা একমত। কিন্তু তাদের কারখানায় কর্মবিরতির বিষয়টি তারা পছন্দ করেন না। তারা বলেন, মেশিনের চাকা থেমে গেলেতো পেটও থেমে যাবে। তাই যে করেই হোক কারখানা সচল রেখে অন্য কোনো উপায়ে আন্দোলন করতে হবে।
একের পর এক কারখানায় কী ভাবে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো- এটা জানতে চাইলে, এই শ্রমিকরা বলেন- কেউ নেতৃত্ব দিচ্ছে কিনা তা তারা জানেন না। তাহলে আপনারা কেনো কর্মবিরতিতে গেলেন- জানতে চাইলে তারা বলেন, বেশির ভাগ শ্রমিক যখন আন্দোলনে নামে তখন বসে থাকা যায় না। এক কারখানার শ্রমিকের কাছ থেকে অপর কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনের কথা শুনে আন্দোলনে নামে। এভাবেই এক কারখানা থেকে অপর কারখানায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
কারখানা বন্ধ ঘোষণার বিষযটি শ্রমিকরা মানতে পারছেন না। সালেহা নামের একজন শ্রমিক বলেন, তিন বছর আগে ৫হাজার ৩০০টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতিবছর যে হারে বেতন বাড়ে তার চেয়ে দ্রব্য মূল্য, পরিবহন ভাড়া, ওষুধের মূল্য, পোশাকের মূল্য, বাড়ি ভাড়াসহ নিত্য ব্যবহার্য সকল জিনিসেরই দাম বেড়ে যায়। শুধু বাড়ি ভাড়া না বাড়ালেও তাদের বর্তমান বেতন কাঠামোতো সংসার চলেনা বলে উল্লেখ করেন।
গত দুই দিন ধরে কারখানা বন্ধ এবং আন্দোলনকালীন দিনগুলোরও বেতন মালিক পক্ষ দিতে রাজী নায়- এমন কথা জানালে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক বলেন, বেতন না দিলে তাদের সমস্যা হবে। বাড়ি ভাড়া ও মুদি দোকানের বকেয়া পরিশোধ করতে পারবেন না তারা। আবার অনেক শ্রমিক বলেন, অন্যত্র গিয়ে কাজ নিবে। আবার কেউ কেউ বলেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করে মালিকরা কারখানা নির্মাণ করে, বেশিদিন কারখানা বন্ধ রাখলে ক্ষতি মালিকদেরও কম হবে না। শ্রমিকরা তাদের বেতন বাড়ানোর ব্যাপারে আলোচনার মাধ্যমে একটা সমাধান চান।
আবারো শ্রমিক ছাঁটাই ও মামলা দায়ের
চলমান ন্যূনতম মজুরি কাঠামো বাড়ানোর দাবির আন্দোলনে আবারো শ্রমিক ছাঁটাই ও মামলা করেছেন দুটি কারখানার কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার সকালে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকার ফাউন্টেইন গার্মেন্টের প্রধান ফটকে ১৩৫জন শ্রমিককে ছাঁটাইয়ের নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
ফাউন্টেইন গার্মেন্টের প্রডাকশন ইনচার্জ সুমন হাসান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। চলমান শ্রমিক আন্দোলনে উসকানির অভিযোগে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ১৩৫জন শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে বলে তিনি জানান। তবে ছাঁটাইয়ের সংখ্যা আরো বাড়তেও পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
অপরদিকে, শ্রমিক আন্দোলনে উসকানির অভিযোগে উইন্ডি গ্রুপ ও ফাউন্টেইন কারখানার দুই শতাধিক শ্রমিকের বিরুদ্ধে বুধবার পৃথক দুটি মামলা দায়ের করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার পর বুধবার রাতে হা-মীম গ্রুপের পক্ষ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়। চার শতাধিক শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে এ মামলার নিশ্চিত করেন আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শামীম আহমেদ।
মামলা সূত্রে জানা যায়, চলমান শ্রমিক অসন্তোষ চলাকালে আশুলিয়ার নরসিংহপুর এলাকার হা-মীম গ্রুপের শ্রমিকরা কারখানার নিয়ম ভেঙে আন্দোলন শুরু করে। পরে কর্মবিরতি পালনের পাশাপাশি কারখানা থেকে বের হয়ে সড়কে এসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালায় শ্রমিকরা। এ ঘটনায় কারখানা কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানাটি বন্ধ ঘোষণা করেন। সেই সাথে শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগে কারখানাটির পাঁচ শ্রমিকের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও চার শতাধিক শ্রমিকের নামে কারখানা কর্তৃপক্ষ মামলাটি দায়ের করেন।
এ নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় ৬ শতাধিক অজ্ঞাতসহ শ্রমিকের বিরুদ্ধে পৃথক ৩টি মামলা দায়ের হয়েছে। এঘটনায় দুই শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনের পাঁচ শ্রমিক নেতাকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
শ্রমিক সংগঠনের পাঁচ নেতা আটক
তিনটি কারখার মালিক পক্ষের মামলার পর শ্রমিক সংগঠনের পাঁচ শ্রমিক নেতাকে থানায় ডেকে নিয়ে আশুলিয়া থানা পুলিশ আটক করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আটক পাঁচ শ্রমিক নেতা হলেন, গার্মেন্ট শ্রমিক ফ্রন্টের সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি সৌমিত্র কুমার দাশ, গার্মেন্ট অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি আল কামরান, সাধারণ সম্পাদক শাকিল ও বাংলাদেশ তৃণমূল গার্মেন্ট শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শামীম খান।
আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মহসিনুল কাদির বলেন, গত কিছু দিন ধরে উসকানিমূলক কয়েকটি কর্মকান্ডের জন্য ওই পাঁচ শ্রমিক নেতাকে আটক করা হয়েছে। তিনি বলেন, গত ২৮ নভেম্বর জামগড়ায় ফ্যান্টাসি কিংডমের সামনে সৌমিত্র কুমার দাশ এক গণসমাবেশের আয়োজন করেন। শামীম খান ও রফিকুল ইসলাম সুজন মিলে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে গোপনে আশুলিয়ার বেরন এলাকায় আরও একটি সমাবশে করে। তারা ১৬টি দাবিতে শ্রমিকদের মধ্যে লিফলেট বিতরণ করেন। এছাড়া আল-কামরান ও শাকিল আহমেদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দাবিতে শিল্পাঞ্চলে লিফলেট বিতরণ করে শ্রমিকদের উস্কে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
কারখানা খুলে দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবি মেনে নেওয়ার আহবান
অবিলম্বে আশুলিয়ার সকল কারখানা খুলে দেয়া, গ্রেপ্তার ও মামলা প্রত্যাহার, কারখানা ভিত্তিক দাবি দাওয়া মানা, মজুরি বোর্ড গঠন করে ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার এবং মোট মজুরি ১৬ হাজার টাকা করার উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির নেতৃবৃন্দ।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির কেন্দ্রীয় সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার এবং সাধারণ সম্পাদক জুলহাস নাইন বাবু এক যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি জানান।
নেতৃবৃন্দ বলেন, গত প্রায় ১০ দিন ধরে মজুরি বৃদ্ধির দাবি এবং কারখানা ভিত্তিক দাবিতে ও শ্রমিক ছাঁটাই-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আশুলিয়া শ্রমিকাঞ্চল আন্দোলনে উত্তপ্ত। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২০ ডিসেম্বর শ্রমিকদের উপর পুলিশ টিয়ারসেল, রাবার বুলেট ছুড়ে ১০ জনকে আহত করে এবং একই দিনে ৫৫টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে বিজিএমইএ। ২১ ডিসেম্বর পুলিশ র্যাবের পাশাপাশি ১৫ প্লাটুন বিজেবি মোতায়েন করে শ্রমিকদের মধ্যে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া উইন্ডি, ফাউন্টেন এবং হা-মীমগ্রুপের কর্তৃপক্ষ প্রায় দেড় হাজার শ্রমিকের বিরূদ্ধে কারখানা ভাঙচুর ও লুটপাটের মিথ্যা মামলা করেছে। উইন্ডি কারখানার ১২১ জন শ্রমিককে বরখাস্ত এবং ২ জন শ্রমিকসহ ৭ শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নেতৃবৃন্দ বলেন, শ্রমিকদের বিরূদ্ধে এই রকম মিথ্যা মামলা- গ্রেপ্তার, শ্রমিকাঞ্চলে দমন পীড়ন ও ভয়ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি কিংবা ১৩(১) ধারায় মালিকপক্ষের ৫৫টি কারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত সমস্যা সমাধানের কোন পথ সৃষ্টি করবে না। কারখানা শ্রমিকদের রুটি রুজির জায়গা, সেই জায়গা অচল করতে শ্রমিকরা চান না। শ্রমিকরা কাজ করতে চায়, কারখানায় যেতে চায়, উৎপাদনের গতি চলমান রাখতে চায় । তার জন্য প্রয়োজন প্রত্যক কারখানায় গণতান্ত্রিক কর্ম পরিবেশ। নেতৃবৃন্দ বলেন, শ্রমিক স্বার্থের পক্ষে সংগঠনগুলো মজুরি বৃদ্ধির দাবি করে আসছিলো। তার সাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উর্ধ্বগতি, পানি-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, বাসা ভাড়া ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবনা শ্রমিকদের দাবির যৌক্তিকতাকে সামনে এনেছে।
নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, সরকার এবং মালিকপক্ষ বারবার বলছেন শ্রম আইনানুযাী ৫ বছর এর মেয়াদকালে মজুরি বৃদ্ধি করার যাবে না। এই বিষয়ে শ্রম আইনের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা সরকার ও মালিকের দেয়া উচিত বলে তারা মনে করেন। শ্রম আইনে যেমন ৫ বছরের কথা উল্লেখ আছে তেমনি এও উল্লেখ আছে প্রয়োজনে ৩ বছরে পর্যালোচনা করা যাবে। সাধারণত ৫ বছর পর পর মজুরি বোর্ড গঠনের বিধান থাকলেও ১৪০ ধারার (ক) এ স্পষ্ট উল্লেখ আছে ৯১[ ১৪০ক আইনের ধারা ১৩৯, ১৪০ ও ১৪২ এ যে বিধানই থাকুক না কেন, বিশেষ পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সরকার কোন শিল্প সেক্টরের জন্য ঘোষিত নিম্নতম মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের যে কোন পর্যায়ে নূতনভাবে নিম্নতম মজুরি কাঠামো ঘোষণার জন্য নিম্নতম মজুরি বোর্ড পুনঃগঠন এবং প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা প্রতিপালন সাপেক্ষে পুনরায় নিম্নতম মজুরি হার ঘোষণা করতে পারবে। এই আইনের আওতায় বর্তমান পরিস্থিতিতে মজুরি বৃদ্ধির জন্য মজুরি বোর্ড জরুরি মনে করেন এ নেতৃবৃন্দ।