নতুন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) তৈরিতে কঠোর হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। আর্থিক শৃংখলা রক্ষা, প্রকল্প বাছাইয়ে স্বচ্ছতা ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
গত সোমবার জারি করা এক পরিপত্রে আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের নতুন এডিপি তৈরি করতে ৩০টি নীতিমালা মেনে চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে তালিকাভুক্ত সম্ভাব্য সমাপ্য কোনো প্রকল্প আগামী অর্থবছরের এডিপির জন্য প্রস্তাব করা যাবে না। ২০১৭ সালের জুনে মেয়াদ উত্তীর্ণ কোনো প্রকল্প মেয়াদ বৃদ্ধি ছাড়া নতুন এডিপিতে যুক্ত করা যাবে না।
এ ছাড়া সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও কাক্সিক্ষত সুফল পেতে নতুন প্রকল্প গ্রহণ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এর পরিবর্তে চলমান প্রকল্প যথাসময়ে সমাপ্ত করতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
এদিকে আগামী অর্থবছরের জন্য বৈদেশিক ঋণ নির্ধারণে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সঙ্গে দু’দিনের সিরিজ বৈঠকে বসছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
উন্নয়ন প্রকল্পের নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবে প্রয়োগের মধ্যে ফারাক কমিয়ে আনার তাগিদ দিয়েছেন বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী।
বৃহস্পতিবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, নীতিমালা শক্ত হাতে প্রয়োগ করতে হবে। এডিপির আকার বাড়ালেই শুধু হবে না, এর সুষ্ঠু ও কার্যকর বাস্তবায়ন করা জরুরি। তিনি আরও বলেন, প্রকল্প নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।
যেমন বাস্তবায়ন সামর্থ্যরে তুলনায় প্রকল্প সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে অল্প অল্প বরাদ্দ দিয়ে রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ও ব্যয় বেড়ে যায়। অন্যদিকে কমে যায় মান। সেইসঙ্গে প্রকল্প থেকে যে সুফল পাওয়ার কথা তা পাওয়া যায় না। সুতরাং পরিকল্পনা কমিশনকে কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই।
জানতে চাইলে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এডিপিতে ছোট ছোট নতুন প্রকল্প নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি অবকাঠামো, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বড় প্রকল্প গ্রহণে গুরুত্ব দিতে হবে।
তাছাড়া চলমান বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পগুলো সময়ের মধ্যে সমাপ্ত করতে সরকারের পক্ষে কী করণীয় এবং দাতাদের কি সহযোগিতা প্রয়োজন এসব নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, স্বল্প সুদের বৈদেশিক সহায়তা যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে, তার সর্বোত্তম ব্যবহার করা প্রয়োজন।
নতুন এডিপি প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, এডিপি তৈরির ক্ষেত্রে অবশ্যই নীতিমালা মেনে চলতে হবে। এটি করাই হয় যাতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো তা মেনে চলে।
সূত্র জানায়, পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ থেকে জারি করা পরিপত্রে এডিপি প্রণয়ন বিষয়ে সাধারণ ৮টি নীতি, নতুন প্রকল্প অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে ১২টি এবং এডিপিতে প্রকল্পভিত্তিক অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে ১০টি নীতিমালা মেনে চলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, শুধু অনুমোদিত চলমান প্রকল্প বরাদ্দসহ এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত এবং প্রশাসনিক আদেশ জারি ছাড়া কোনো প্রকল্প অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা যাবে না। যেনতেনভাবে বরাদ্দ না দিয়ে পূর্ববর্তী বছরের বরাদ্দ ও অগ্রগতি বিবেচনায় নিয়ে উন্নয়ন সহায়তা খাতে বরাদ্দ দিতে হবে।
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত নতুন প্রকল্প ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এডিপিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্তর্ভুক্ত হবে না। উচ্চ অগ্রাধিকার প্রাপ্ত না হলে সরকারি তহবিলের অর্থে সম্পূর্ণ নতুন প্রকল্প নেয়া পরিহার করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধসংক্রান্ত, নদীভাঙন, নদী ড্রেজিং ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রকল্প অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে।
এ ছাড়া জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ, বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট, আগামী অর্থবছরে সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত এবং দ্রুত অগ্রগতিসম্পন্ন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
চলতি প্রকল্পগুলোর সর্বশেষ অনুমোদিত প্রাক্কলিত ব্যয় এবং ক্রমপুঞ্জিত অগ্রগতি বা ব্যয়ের ভিত্তিতে সম্ভাব্য যৌক্তিক ব্যয়ন বিবেচনায় নতুন অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ প্রস্তাব করতে হবে।
নতুন এডিপির কাজ চলছে : পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য অনুযায়ী আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এ লক্ষ্য পূরণে এডিপির আকার ধরতে হবে ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা (সরকারি, বৈদেশিক ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা মিলে)।
কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় নতুন মূল এডিপির সম্ভাব্য আকার হবে এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে মূল এডিপির আকার ছিল এক লাখ ২৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা বাদ দিয়ে এক লাখ ১৯ হাজার ২৯৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকার সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) অনুমোদন করা হয়। ইআরডি সূত্র জানায়, আগামী ২ ও ৩ এপ্রিল নতুন এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা ও প্রকল্প সাহায্য বরাদ্দ প্রাক্কলনের জন্য ইআরডির ভারপ্রাপ্ত সচিব কাজী শফিকুল আযমের সভাপতিত্বে বৈঠকে বসছে ইআরডি। প্রথমদিন বৈঠক হবে ১৩টি খাতসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে। এগুলো হচ্ছে : বিদ্যুৎ খাত, তেল-গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ, যোগাযোগ, সমাজকল্যাণ-মহিলাবিষয়ক ও যুব উন্নয়ন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য-পুষ্টি-জনসংখ্যা ও পরিবারকল্যাণ, কৃষি, পরিবহন, শিক্ষা ও ধর্ম, যোগাযোগ, শিল্প, বিজ্ঞান-তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান খাত। দ্বিতীয় দিন সোমবার অনুষ্ঠিত হবে চারটি খাতের বৈঠক। এগুলো হচ্ছে : ভৌত-পরিকল্পনা-পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন, পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান, পানিসম্পদ এবং জনপ্রশাসন খাত। এ প্রসঙ্গে ইআরডির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তা ধরা হয়েছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। সেখান থেকে সংশোধিত এডিপিতে ৭ হাজার কোটি টাকা বাদ দিয়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
সুতরাং এখনও বলা যাচ্ছে না আগামী অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তা কত হবে। তবে বৈঠকে আলোচনার পর মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বরাদ্দ নির্ণয় করা হবে।
অন্যদিকে বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত করে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে চিঠি পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইআরডি।