শুধু নিবন্ধন রক্ষায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধানে গুরুত্ব না দিয়ে নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি কৌশল হিসেবে ক্ষমতাসীনরা সামনে নিয়ে আসছে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তারা নির্বাচনে অংশ নেয়া বা না-নেয়ার ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের বিষয়টি তেমন গুরুত্বই দিচ্ছেন না। এ ইস্যুতে সরকারের কোনো ধরনের ফাঁদে পা দেবে না দলটি।
তবে দলটির নীতিনির্ধারকদের অনেকেই মনে করেন, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিয়ে শেষ মুহূর্তে একটি সমাধানে আসবে ক্ষমতাসীনরা। এমনটা ধরে নিয়েই আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। এরই অংশ হিসেবে যত দ্রুত সম্ভব দল পুনর্গঠন, নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি এবং প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও দলটি শুরু করেছে। আর যদি সরকারের ওপর পর্যাপ্ত চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব না হয়, তাহলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো একতরফা আরেকটি নির্বাচন করার চেষ্টা চালাবে ক্ষমতাসীনরা।
বিএনপির সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের বিষয়টি এড়িয়ে যেতেই ক্ষমতাসীনরা নিবন্ধনের বিষয়টিকে সামনে এনেছে। সরকারের এ কৌশলে পা দেবে না তারা। সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করাই তাদের মূল লক্ষ্য।
এ জন্য আন্দোলনের প্রস্তুতি, কূটনৈতিক মহলে যোগাযোগ বাড়ানোসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। শুধু বিএনপি নয়, প্রভাবশালী দেশগুলোও বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জোরালোভাবে কাজ করছে। এ অবস্থায় শিগগির নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখা দেয়ার কাজও শেষ করে আনা হয়েছে।
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আইন মানুষের উপকারের জন্য। যে আইন মানুষের উপকারে আসে না, সেটি আইন নয়। নির্বাচন বিষয় নয়, বিএনপি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নির্বাচন নয়। সরকার একই কায়দায় ছলচাতুরী করে, প্রতারণা করে গোল করতে চায়। কিন্তু তা এত সহজ নয়। বিএনপিকে নির্বাচনে নিতে নানা ষড়যন্ত্রের কথা শোনা যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ফখরুল বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। সব সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত আছে। নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে বলে আশা করি। সেই নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতিও আমাদের রয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা মনে করি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে হবে না। ওই নির্বাচন হবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে। ওই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া জাতীয় নেতা হিসেবে নির্বাচনকালীন একটি সহায়ক সরকারের প্রস্তাব দেবেন।’
আরপিও (জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা রিপ্রেজেনটেটিভ অব পাবলিক অর্ডার) ৯০ এইচ(১) ধারায় রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পাঁচটি কারণে কমিশন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। এই ধারার (ই) উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হবে, যদি কোনো রাজনৈতিক দল পরপর দুটি সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়।
অবশ্য নিবন্ধন বাতিলের ক্ষেত্রে কোনো দল যদি ৯০ এইচ(১)(ই) ধারা লংঘন করে, সে ক্ষেত্রে দলটির নিবন্ধন সরাসরি বাতিল হবে না। পরপর দু’বার নির্বাচনে অংশ না নেয়া দলটিকে শুনানিতে অংশ নেয়ার সুযোগ দেবে। কমিশনের কাছে দলটির বক্তব্য গ্রহণযোগ্য না হলেই কেবল তারা নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেবে।
আরপিও’র এ ধারা উদ্ধৃত করে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা বলতে শুরু করেছেন, ‘নিবন্ধন রক্ষা করতে বিএনপিকে নির্বাচনে আসতেই হবে।’ দলীয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি নিবন্ধন নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের দেয়া বক্তব্য নিয়ে দলের কয়েক সিনিয়র নেতা চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। খালেদা জিয়া বিষয়টি পাত্তা দেননি।
এ নিয়ে চিন্তা না করে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ করার নির্দেশ দিয়ে তিনি (খালেদা জিয়া) বলেন, দেশের মানুষ বিএনপির দিকে তাকিয়ে আছে। তারা মনেপ্রাণে বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, নিবন্ধন দিয়ে রাজনীতি হয় না। দেশে কারা রাজনীতি করবে তা ঠিক করবে দেশের জনগণ। নির্বাচন যত এগোবে সমীকরণও নতুন হবে। পরিস্থিতি বলে দেবে কখন কী হবে।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই হবে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারাই বলছেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন তারা আর করতে চান না। তাদের কথার মধ্যেই তো বোঝা যায়, পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেখ হাসিনার অধীনে নয় নির্বাচনকালীন একটি সরকারের অধীনে হবে।’
জানা গেছে, চলমান পরিস্থিতিতে সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন দেশের ৫ বুদ্ধিজীবী। তারা খালেদা জিয়াকে দ্রুত দল পুনর্গঠন করাসহ একটি আদর্শিক জোট গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন।
বৈঠকে অংশ নেয়া গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বিএনপির জনসমর্থনের কোনো কমতি নেই। কিন্তু তাদের সমর্থকরা রাজপথে নামছে না। সমর্থকদের রাজপথে নামাতে হলে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাজপথে নামতে হবে।
তার আগে তাকে ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, সিপিবি-বাসদসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের বাসায় গিয়ে চা খেতে হবে। দেশের চলমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সবাইকে নিয়ে একটি আদর্শিক ফ্রন্ট গঠন করতে হবে। এ ফ্রন্টের কর্মকাণ্ড যদি আস্থা ফেরানো যায়, তাহলে জনগণ রাস্তায় নামবে।
চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি দিয়ে নেতাকর্মীদের ঘর থেকে মাঠে নামানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে রাজধানীতে সিনিয়র নেতাদের নেতৃত্বে লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি করা হয়েছে। এভাবে কর্মসূচি করে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার দাবিতে গণজাগরণ করা হবে।
একই সঙ্গে সরকারের ওপর কূটনীতিক চাপও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সম্প্রতি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. রিয়াজ রহমান ও বিশেষ সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপনের নেতৃত্বে পররাষ্ট্র উইং সংক্রান্ত একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি পুরোদমে কাজ শুরু করেছে।
বিএনপির কূটনীতিক উইং সূত্রে জানা যায়, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হওয়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন বিদেশী কূটনীতিকরা। বিষয়টি নিয়ে তারাও কাজ করছেন। ইতিমধ্যে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বিএনপি ও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
সম্প্রতি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্ল–ম বার্নিকাট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদু। ঢাকা সফরের সময় যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দফতরের মন্ত্রী অলোক শর্মাও বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও চলছে নানা প্রচেষ্টা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নির্বাচনমুখী দল। অংশগ্রহণমূলক যে কোনো নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি আমাদের আছে।’
নিবন্ধন বাতিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নিবন্ধন নিয়ে যাদের চিন্তা, উনারা সেই চিন্তা নিয়ে থাকুক। আমাদের নিবন্ধন নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। ভয়ে বিএনপি নিবন্ধনের জন্য নির্বাচনের যাবে- এটা যারা বিশ্বাস করেন, তারা বোকার রাজ্যে বসবাস করছেন।’